। হাবেলী ডিজিটাল ডেস্ক । আগরতলা ।৩০ জুন।
প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরা রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয় এক অপার লোকজ আনন্দোৎসব খার্চি উৎসব ও মেলা। এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আহ্বানে মুখরিত হয় রাজধানী `আগরতলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরের পুরাতন আগরতলা ব্লকের খয়েরপুর এলাকা। সেখানে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী চতুর্দশ দেবতা মন্দির। রাজ্যের জাতি জনজাতি অংশের প্রাণ মানুষ অপেক্ষা করেন বছরের এই বিশেষ মুহূর্তের জন্য সাত দিনব্যাপী খার্চি উৎসব ও মেলার জন্য। এবছর এই মেলা শুরু হবে আগামী ৩ জুলাই, চলবে ১ জুলাই পর্যন্ত। এই সময়কালে দেবতা বাড়ির পরিবেশ হয়ে উঠে পুণ্যতীর্থ, মন্দির প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে এক মহামিলনের ক্ষেত্র। জাতি কিংবা জনজাতির গন্ডি পেরিয়ে, রাজ্যের সব অংশের মানুষ এই উৎসবে মিলিত হন ধর্মীয় শ্রদ্ধা, সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক উচ্ছ্বাসে। শুধু ধর্মীয় অনুভূতি নয় এই মেলা বা উৎসব হয়ে উঠে জাতি-জনজাতি ও নানা সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষের এক মিলন ক্ষেত্র। নানা আচার অনুষ্ঠান, লোকজ উৎসব, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং মেলা প্রাঙ্গণের বৈচিত্রময় পরিবেশ যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এই পবিত্র তীর্থভূমি। খার্চি মেলা তাই কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এ এক ঐক্য, আস্থা ও আবেগের প্রতীক।
খার্চি উৎসব কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়-এটি ত্রিপুরার বহু প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যা বহু বছর ধরে মানুষের হৃদয়ে এক অভিন্ন বন্ধনের সুর বেঁধে রেখেছে। চতুর্দশ দেবতার মন্দির যা ত্রিপুরার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে বলা হয় চন্তাই। চন্তাইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী চতুর্দশ দেবতার মধ্যে শিব, উমা, হরি লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয়, গণেশ, ব্রহ্মা, পৃথিবী, সমুদ্র, গঙ্গা, অগ্নি, কামদেব ও হিমাদ্রি এই চৌদ্দ জন দেবদেবীই খার্চি পূজার সাতদিন পূজিত হন। তাঁদের মধ্যে হর বা শিব হলেন প্রধান। এই মন্দিরে প্রতিদিন নিত্য পূজিত হন শিব, উমা ও হরি। ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য বার বার মোগল আক্রমনের জন্য রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর থেকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। সেদিন তাঁর দৃষ্টি পড়ে বর্তমান খয়েরপুর অঞ্চলের দিকে, আর সেখানেই স্থাপন করেন নতুন রাজবাড়ি বা হাবেলী। তৈরী করেন নতুন রাজধানী যা বর্তমানে পুরাতন আগরতলা বা পুরাতন হাবেলী নামে পরিচিত। নতুন রাজধানীতে মহারাজা প্রতিষ্ঠা করেন চতুর্দশ দেবতার মন্দির। বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরের পর চতুর্দশদেবতা থেকে যান পুরাতন আগরতলাতেই। খাচি পূজা সময়ের গন্ডি পেড়িয়ে রাজ্যবাসীর প্রাণের উৎসবে পরিনত হয়েছে।খার্চি পূজার প্রাকদিনে, ধর্মীয় পরম্পরার অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্দশ দেবতার স্নানযাত্রা। এই পবিত্র স্নান যাত্রা প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয় হাওড়া নদীর নির্ধারিত স্নান ঘাটে। সেখানে জড়ো হন অসংখ্য ভক্ত, দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থীগণ। চতুর্দশ দেবতার প্রধান পুরোহিত, যিনি রাজচন্তাই নামে পরিচিত তার নেতৃত্বে অন্যান্য পুরোহিতগণ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগন এই স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। দেবদেবীর মঙ্গল স্নান, ধূপধুনো, বাদ্যযন্ত্র আর উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দিরে এলাকা। খার্চি উৎসব ও মেলা উপলক্ষে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগে মেলা প্রাঙ্গনে প্রদর্শনী স্টল খোলা হয়। এই স্টলগুলির মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সরকারের বহুমুখী উন্নয়নমূলক কাজ। যেখানে আগত সাধারণ মানুষ সহজভাবে জানাতে পারেন সরকারি প্রকল্পের উপকারিতা; আবেদনের পদ্ধতি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা। সরকারি কর্মীরা উপস্থিত থেকে সরাসরি নাগরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন, প্রদান করেন তথ্য ও প্রচার পত্র। এই উদ্যোগ শুধুমাত্র প্রদর্শণ নয়, এ এক নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের সেতু, যা প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খার্চি মেলার উপলক্ষে রাজ্যের নানা প্রান্ত তো বটেই, রাজ্যের সীমানার বাইরে থেকেও আগমন ঘটে বহু সাধু, সন্ত, সাধক, পর্যটক ও বিশিষ্টজনের। দেখা মেলে বিদেশী পর্যটকদেরও। খার্চি মেলার আনন্দঘন পরিবেশে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত হয় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। উৎসবের প্রতিটি সন্ধ্যায় মেলার প্রাণকেন্দ্র কৃষ্ণমালা মঞ্চ হয়ে ওঠে শিল্প সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র। যেখানে রাজ্য ও বহিঃরাজ্য থেকে আগত গুণী শিল্পীদের পরিবেশনায় নাচে, গানে বর্ণময় হয়ে উঠে কৃষ্ণমালা মঞ্চ।
পাশাপাশি হাবেলী মঞ্চে শিশুদের নিয়ে আয়োজিত হয় বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। যেখানে ছোট্ট শিল্পীরা তাদের সৃজনশীলতার ডানা মেলা ধরে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তির মাধ্যমে। উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে বসে আঁকো প্রতিযোগতা। যেখানে শিশুদের তুলির টানে ফুটে উঠে কল্পনার রঙিন জগৎ। বহু বছর ধরে চলে আসা এই খার্চি পূজা আজ নিজস্ব রীতি নীতিকে অক্ষুন্ন রেখে সমস্ত ধর্মীয় গন্ডি অতিক্রম করে এক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। যেখানে একত্রিত হন পুণ্যার্থী, পর্যটক এবং ব্যবসায়ীগণ। খার্চি পূজা শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নয়, এ এক গৌরবময় ঐতিহ্য।