। হাবেলী ডিজিটাল ডেস্ক।
আগরতলা।১৩ এপ্রিল।
চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা বর্ষের শেষ দিন।
হিন্দু, মুসলিম,জনজাতি অংশের মানুষ এই দিনকে বিভিন্ন নামে পালন করে থাকে।প্রতিটি সম্প্রদায়ের কাছে এই দিনটি পৃথক পৃথক খুব তাৎপর্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে।যেমন দেবনাথ,যোগী,সাহা,পাল, নাপিত,ধোফা,লস্কর সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন নামে এই দিনে বিভিন্ন প্রজাতির সব্জি একসাথে রান্না করে দুপুরে খেয়ে থাকে।এই দিনের সব্জি তরকারি নাম এক এক সম্প্রদায়ের কাছে ভিন্ন রকম।
জনজাতি সম্প্রদায়ের চাকমা , দেবর্বমাসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী এই সব্জি পাচন এই খেয়ে থাকে।
চৈত্র সংক্রান্তি কে কেন্দ্র করে নোয়াখালী যোগী সম্প্রদায়ের বাড়িতে এক সপ্তাহ আগে থেকে কাজ শুরু করে দেয়া হয়। বছর শেষ হবার আগে বাড়িতে ব্যবহার যোগ্য শোয়ার ঘরে বিছানা পত্র ধূয়ে পরিস্কার করা হয়। ঘরের ভেতরে বাইরে চারিদিকে মাকড়সা জাল,সহ যাবতীয় ধূয়ে মুছে পরিষ্কার করে নেয়া হয়। বাড়ির চারিদিকে লতাপাতা আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করা হয়।জমাকৃত আবর্জনা এক জায়গায় স্তপ দিয়ে সেগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
সংক্রান্তি আগের রাতে বেল ,লেবু, বেত,জাববূরা এবং খেজুর কাঁটা সহ ডালা বাড়ির উঠানে জমা করে রাখা হয়।তবে পাঁচ রকম কাঁটা গাছের ডালা আগুনে পোড়ানো হয়।এর সাথে থাকে বিশ কাটালি বলে এক ধরনের গাছ।এই গাছগুলো নদী বা ছড়ার জলের পাশে সেত সেতে অংশে জন্মায়। সংক্রান্তি কিছু দিন আগে সেই গাছ তুলে এনে বাড়িতে শকিয়ে নিতে হয়।ভেজা থাকে।তাহলে আগুনে পোড়ানো যাবে না।
এই জন্য সংক্রান্তি আগের রাতের খাবার শেষ হয়।রাতে শোবার আগে নোয়াখালী যোগী দের একটি মন্ত্র আছে। সেই মন্ত্রটি মুখে বলে বলে বাড়ির চারপাশে ঘুরে নিতে হয়। এই কাজ শেষ হবার পর রাতে শয়নে যাবে।সংক্রান্তি দিন ভোর হবার আগে অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠে যেতে হবে।ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে পুনরায় ভোররাতে মন্ত্র বলা হয়। বাড়ির সকল পুরুষ মানে বৃদ্ধ থেকে শিশু তাতে অংশ নেন। এই বার বাড়ির উঠানে জমা কৃত পাঁচ কাটা সহ অন্যান্য সামগ্রীতে অগ্নি সংযোগ করে দেয়া হয়।সকলে এক সাথে বসে আগুনে পোড়ানো সামগ্ৰীর ধোঁয়া মিশ্রিত গ্যাস শরীর ত্যাজ লাগাবে।
আগুন পোহানোর কাজ শেষ হয়। তারপর বাড়ির পুরুষগন গোয়াল ঘরে থেকে গরু বের করে বাইরে কোথাও বাঁধে।হয় সেখানে নয় যেখানে জল রয়েছে। সেখানে গাভি সহ অন্যান্য গুরুদের স্থান করানো হয়। তারপর গরুর গলায় ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়।
আগুনে পোড়ানো ছাই একাংশ জলের সাথে মিশিয়ে বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ছিটানো পর পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করে নেয়া হয়।
ছাইয়ের কিছু অংশ সাথে আগের রাতের জল দেয়া ভাত।মানে প্রান্তাভাতের সাথে মিশিয়ে চাষী চাষের জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে আসে।
এই দিকে বাড়িতে সব কাজ শেষ করে নেন। তারপর বাড়ির গৃহবধূ স্থান করে শুদ্ধ হন। নতুন কাপড় পরিধান করেন। গৃহবধূ বাড়িতে সব ঘরের দরজায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে দেন। সাথে ঘরের দরজায় সিঁদুর ফোঁটা সহ অন্যান্য সামগ্ৰী দেন।
পুরুষগন বাড়ি বাইরের সব কাজ শেষ করে স্থান করে ঘরে আসে।তখন শক্র ধ্বংসের লক্ষে বাড়ির সামনে রাস্তায় আম বলি দিতে হয়। এই জন্য নাড়ু ছাতু, মুড়ি,চিড়া খৈ মিশিয়ে নেয়া হয় একটি পাত্রে।
কাঁচি বা দা দিয়ে একটি চৌকোটা ঘর আঁকতে হয়। সেখান টায় ছাতু গুলো ঘরটিতে ছিটিয়ে দিয়ে তার উপর একটি ছোট আম বসিয়ে দেয়া হয়। সেটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক কুপে কেটে ফেলতে হবে।
গৃহকর্তার গৃহে যাবার পর গৃহবধূ জল খাবার দেন।তাতে থাকে চিড়া, মুড়ি,খৈ,নাড়ু, গুড় ,কলা, দই সহ যোগে সকালের জলখাবার খেয়ে নেন। পরিবারের সকলে একসাথে বসে এই কাজ টি সেই দিনের মত শেষ করা হয়।
সংক্রান্ত এক সপ্তাহ আগে থেকে যোগী বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।মুড়ি চিড়া খৈ নাড়ু ছাতু পৃথক পৃথক ভাবে তৈরি করতে হয়। এইগুলো তৈরি করতে প্রচুর সময় দরকার।
বিশকচু নাড়ু:- বিশকচুকে কেটে চালের গুঁড়া এবং ছাতুর সাথে মিশিয়ে এই নাড়ু তৈরি করতে দেখেছি।এর সাথে একটু লবণ , শুকনো পোড়ানো মরিচ দিয়ে এইগুলো তৈরি করা হয়। এটি খেতে খুবই সুস্বাদু।বিশকচু শরীর বিশ বেদনা ঔষধ। সেই কারণে চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশকচু নাড়ু তৈরি করে খাওয়া হয়। ভাবছেন কিভাবে খাব। তৈরি করা পদ্ধতি জানলে আপনি ও খাবেন।
ঐতিহ্যবাহী পাচন :-
পাচনে উপকরণ হল :- কাঁচা কাঁঠাল, কাঁচ কলা,চুবুই ( কলা গাছের ভেতরের শক্ত অংশ) ,
মিষ্টি আলু,কুমোড়,চাল কুমড়া, সিম, পটল, জিঙ্গে,কাকড়ল,লতা,কচু, গাজর, থানকুনি পাতা,এলেনচা,বনকলা,তারা,মাটির আলু, ঢেড়শ,মূলা,ইত্যাদি।
বাদাম, মটর, কাম্বলি মটর, সিমের বিচিসহ অন্যান্য দানাজাতিয় বিচি,। রসুন।তেজ পাতা,আদা, পাঁচ মেশালী।
কতজনের জন্য পাচন রান্না করবেন।এর উপর নির্ভর করে আপনী সব সামগ্ৰী সংগ্ৰহ করবেন। সম্পূর্ণ রান্না কিন্তু তেল ছাড়া রান্না করা হয়। এই তেল ছাড়া পাচন দুপুরে পর থেকে এক বাসা থেকে অপর বাসায় বিলি বন্টন চলতে থাকে।সাথে থাকে এই ঘর থেকে ঐঘরে পাচন খাওয়া দাওয়াত। সেই যে কি আনন্দ।আর কখনও ফিরে আসবে? আধুনিকতার ছোঁয়াতে হারিয়ে যেতে বসেছে নোয়াখালী যোগী সম্প্রদায়ের এতিহ্যবাহি পাচনের চৈত্র সংক্রান্তি। এই পাচনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল আয়ুর্বেদিক ওষুধ গুনাগুণ।