agartala Book fair, Agartala Boy mela

আগরতলা বইমেলার সালতামামি ।।পারিজাত দত্ত৷৷

হাবেলী ডিজিটাল ডেস্ক। ৫ র্মাচ। আগরতলা।

‘দাঙ্গা-বিক্ষত এক রাজ্যকে শুশ্রূযার আলো দেখানো’র জন্য যে বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৮১ সালে, সেই আগরতলা বইমেলা আমাদের মনন চিন্তনকে ঋদ্ধ করার, সামাজিক উত্তরণের দিক নির্দেশের এক নিবিড় আশ্রয়স্থল। মানব কল্যাণে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সারা বিশ্বে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে, তার মাঝে দেশের দূরতম প্রান্তে, আয়তনে ক্ষুদ্র, মননশীলতায় ঋদ্ধ একটি রাজ্যের পক্ষে সরকারি উদ্যোগে ৪১তম আগরতলা বইমেলার আয়োজন এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। আমরা হৃদয়ঙ্গম করেছি ‘মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমোঘ উক্তি। জ্ঞানের আলোকবর্তিকা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলে ব্যক্তি তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই বইমেলা আয়োজনের অভিযাত্রা। প্রয়োজনের তাগিদে, মানুষের চেতনা সমৃদ্ধ করার আকুল আকাঙ্খাকে সামনে রেখে বিশ্বের বহু দেশে, এদেশের বিভিন্ন শহরে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ১৯৮০ সালের সেই ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধনের লক্ষ্যে, সুস্থ চিন্তা ও চেতনার বিকাশের লক্ষ্যে ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে আগরতলা বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত। রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গণে ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ প্রথম বইমেলার সূচনা। নয়াদিল্লিতে প্রথম বিশ্ব পুস্তকমেলার নয় বছর পর এবং কলকাতা বইমেলার পাঁচ বছর পর এ রাজ্যে সরকারিভাবে বই মেলার আয়োজন। স্বল্প পরিসরে ২৪টি স্টল নিয়ে শুরু সেই বইমেলা আজ বর্তমানে স্টল সংখ্যা দেড়শ’ ছাপিয়ে গেছে।
ত্রিপুরার লেখালেখি ও প্রকাশনার সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। রাজন্য আমলে রাজসভার অনুপ্রেরণায় গ্রন্থ প্রকাশের যে ইতিহাস তা পরবর্তীকালে আরও বিস্তৃত হয়। মহারাজা ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৪৩১-১৪৬২) ‘রাজমালা প্রথম খন্ড’ প্রকাশ থেকে শুরু করলে বইমেলার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ত্রিপুরার লেখালেখির এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে ত্রিপুরার সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে যে আবেগ ও উদ্দীপনার চিত্র পরিলক্ষিত হয় তা বেগবান হয় আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করেই। বইমেলার পূর্বে হাতে গোনা প্রকাশক ও গ্রন্থপ্রকাশের যে ধারা, তাতে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে আগরতলা বইমেলা। প্রথম বইমেলায় রাজ্যের একমাত্র প্রকাশনা ‘পৌণমীর স্টল ছিল, আর সেই বইমেলায় ‘উত্তরণ’ প্রকাশনী থেকে রাজ্যের সাহিত্যিক নিধুভূষণ হাজরার ‘ছড়ার শতকিয়া’ বইটি প্রকাশিত হয়। চল্লিশ বছরের বেশি সময়কালের পথ চলার পর এই আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে এখন এ রাজ্য থেকে প্রতি বছর বইমেলায় দ্বি-শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই বইমেলাকে ঘিরে সাহিত্য চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে, অনুপ্রাণিত হয়েছেন অগণিত লেখক লেখিকা, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
রাজ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও গ্রন্থ প্রকাশের আধিপত্য থাকলেও এ রাজ্য মিশ্র জনগোষ্ঠীর বাসভূমি এবং বহুভাষিক সাহিত্যচর্চার উজ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে এখানে। আগরতলা বইমেলা

সেই বহুভাষিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটিকে মজবুত করেছে, করেছে প্রাণবন্ত। জনজাতিদের বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগরতলা বইমেলার ভূমিকা অনবদ্য। যুবরাজ রাধা কিশোর মাণিক্য কর্তৃক ‘তিপ্রা বাংলা অভিধান’ সংকলনের প্রয়াসের কথা উল্লেখ থাকলেও ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীচা দৌলত আহমেদ, এস এম দাহা ও শ্রীচা মহম্মদ উমর রচিত ‘ককবরকমা’ কে ককবরককে প্রথম লিখিত গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এই তথ্যগুলোকে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ককবরক ভাষায় লেখালেখি মূলত আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বিকাশিত হয়েছে। আগরতলা বইমেলার তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে ‘ককবরক কগলব বাঁচাব’ এবং ‘সিমালীং সাকাঅ হলংনি খুম’-র পরবর্তী পর্যায়ে ককবরকে অজস্র গ্রন্থের প্রকাশ ঘটেছে, প্রতিটি বইমেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ককবরক বই প্রকাশিত হচ্ছে। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ মণিপুরী, চাকমা সহ বিভিন্ন ভাষায় বহু গ্রন্থের প্রকাশ ঘটছে। শুধু ককবরকভাষীই নন, বাংলা মাতৃভাষা এমন একাধিক লেখকের গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে ককবরকে। আগরতলা বইমেলার সার্থকতা এখানেই। রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গণে স্বল্প পরিসরে যে বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে, স্থান সংকুলন না হওয়ায় ২০০২ সালে ২০ তম বই মেলা স্থানান্তরিত হল শিশু উদ্যান প্রঙ্গণে৷ ২০১৪ সালে উমাকান্ত একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলা স্থানান্তরিত হয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পুনরায় শিশু উদ্যানে হলেও, ২০২০ সাল থেকে হাঁপানীয়া আন্তর্জাতিক মেলা প্রাঙ্গণে বৃহৎ পরিসরে বই মেলার আয়োজন হচ্ছে।
এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে গুণীজনের সমাবেশ ঘটেছে রাজ্যে। বহু বিখ্যাত লেখক ও বিদগ্ধ ব্যক্তির পাদস্পর্শে নন্দিত হয়েছে আগরতলা বইমেলা। নীবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রহমান, শংকর, পূর্ণেন্দু পত্রী, কামাল লোহানী, আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ওয়াই ইবোমচা সিং, সাংবাদিক ও সম্পাদক এন . রাম, মল্লিকা সেনগুপ্ত, ভবানী প্রসাদ মজুমদার, কার্টুনিস্ট কুট্টি সহ বহু গুনীজন বইমেলায় পদার্পণ করেছেন। আগরতলা বইমেলায় প্রাণের সন্ধান তাঁদেরকে আপ্লুত করেছে। বইমেলা এখন শুধুমাত্র পাঠক-লেখক-প্রকাশকদের উৎসব নয়, এ মেলায় বই প্রকাশ অনুষ্ঠান, কবি সম্মেলন, আবৃত্তির আসর, আলোচনা চক্র, আকস্মিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা সহ বিভিন্ন আয়োজনে আগরতলা বইমেলা এখন শিল্প-সাহিত্য চর্চার এক চারণভূমি। এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যিকদেরই শুধু নয়, শিল্প সংস্কৃতি জগতের মেধাবী ও পুরোধা ব্যক্তিত্বদের সম্মানীত ও অনুপ্রাণিত করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। লেখালেখি, ছবি আঁকা, সমাজসেবা, প্রকাশনা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদানের এই উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
‘রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক উৎসব’ বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক-পাঠক-প্রকাশক-সংস্কৃতি প্রেমীদের যে আত্মিক মেলবন্ধন এবং বইমেলাকে কেন্দ্র করে চেতনাকে দীপ্যমান করতে যে যৌথ প্রয়াস, তাতে ‘মেধা ও মননের কর্ষণে’ নিশ্চিতভাবেই আমরা ‘সৃষ্টি ও সত্তার সেই দুর্নীরিক্ষ সত্যের সন্ধান’ এর অভিযাত্রায় সামিল হয়ে সঠিক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি।
*৪১ তম আগরতলা বইমেলা উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ৷ ৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *