যাত্রা,নাটক,কবি আসর :ঢাকির ভবিষ্যৎ অন্ধকার: থাকবে না মাটির প্রতিমা: কিছু স্মৃতিকথা

হাবেলী প্রতিবেদন। আগরতলা।

শরৎকালে শারদোৎসব হয় ।সবাই জানে। এই সময়ে বৃষ্টি থাকে না। এই সময়ে থেকে শিশির ব‌ইতে থাকে। নতুন শিশির ভেজা ভোর দেখা মেলে শিউলি ফুলের সুবাস।তার সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।আকাশ বাতাস করে তোলে মুখরিত।আর এ থেকে গ্ৰাম বাংলায় ভেসে ওঠে শারদীয় উৎসব গন্ধ।

বৃষ্টি থাকে না।আকাশ কেমন নীল রঙের আভায় ঝলমল করতে থাকে।মেঘেরা এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে নিজ আনন্দে ভেসে ভেসে বেড়ায়।দেশ থেকে দেশান্তরে বেড়ায় জানে না কোথায় যায়।
নীল আকাশের নিচে উঠে কাশফুল। কাশফুল শরতের দোলে দোলে আপন মনে। রাখালী ছেলে গরু চড়াতে গিয়ে কাশফুলের উপর কোমল হাত বুলিয়ে আনন্দ অনুভব করে।
জলে স্থলে ফুটে উঠে পদ্ম।এই সময়ে ছাড়া কাশফুল এবং পদ্মফুলে দেখা মেলা ভার। কাশফুল এবং পদ্মফুল আগাম জানান দিবে শরতের আগমন ঘটেছে।মা দুর্গা বাপের বাড়িতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।মা দুর্গা কে বাপের বাড়ি আসবে সেই দিকে লক্ষ্য রেখে সর্বত্র চলে প্রস্তুতি।

শরৎকালে গ্ৰামবাঙালার চাষী সহ সকলে তখন কর্মহীন। চাষী আমন ধানের চারা রোপণ করে এই সময়ে ঘরে থাকেন। সমাজের অন্যান্য শ্রেনীর শ্রমজীবী মানুষের কাজ থাকে না। প্রকৃতি সঠিক সময়ে শরৎ কালে শারদোৎসব সূচনা করেছেন।

শারদোৎসব আগমন উপলক্ষে কুমার তথা পালপাড়ায় দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করে কারিগর। মাঠে ঘাটে তখন কোন কাজ নেই
পালপাড়ার প্রতিটি পরিবারের আবাল বৃদ্ধ সকলে প্রতিমা গড়ার কাজে ব্যস্ত। তখন তাদের ঘরে নাওয়া খাওয়া সময় নেই।অল্প সময়ের মধ্যে যত বেশি প্রতিমা গড়ে তোলা যাবে।তার মাধ্যমে বেশি আয় করা যাবে।সারা বছরের আয় দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করে করতে হবে। বছরের বাকি সময়ে অন্যান্য প্রতিমা তৈরি করে এই পরিমান টাকা আয় করা সম্ভব নয়।
প্রতিমা তৈরি করেন পা
কুমার পাড়ায়। এই অসময়ে বৃষ্টি হয়।তখন প্রতিমা তৈরির কারিগর চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে হয়। বৃষ্টি হলে প্রতিমা শুকাতে দেরি হয়। ভালো করে মূর্তি না শুকাতে পারে । তখন মূর্তি রঙ ভালো ভাবে হয় না। মূর্তির উজ্জ্বলতা বাড়াতে পারে না।

দুর্গা, লক্ষী,স্বরসতী, কার্তিক, গনেশ , অসুরসহ সকল দেবতাকে সাজিয়ে তুলতে হয়। সাজিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন কাগজের ফুলের মালা, কাপড় অন্যান্য সামগ্রী।
সমাজের এক একটি কারিগর এই সব সামগ্ৰী তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সকলেই চায় এই সময়ে বেশি সামগ্ৰী তৈরি করে বেশী অর্থ আয় করতে। অনেক পরিবার সারা বছরের আয় পুজোর সময় করে থাকে। সেই আয় দিয়ে পরিবারের বছর ভর করে থাকে।

দুর্গা পূজার সময় ঢাকি চাই। শরতের আগমনের সাথে সাথে ঢাকির ঘরে শুরু হয়ে যায় তৎপরতা। ঢাকের ভোল তোলার জন্য ঘরে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। যার ঢাকের ভোল ,তাল ,লয় ভালো তার চাহিদা ততবেশী। ঢাকের সাথে থাকে ঢোলী এবং কাসর।কাসর হলে ঢাকির তালে গাম্ভীর্য বজায় থাকে।

রাজ্যের বিভিন্ন গ্ৰাম এবং শহরতলী থেকে পুজো র কয়েক দিন আগে কামান চৌমুহনী, বটতলীতে এসে সমবেত হয়। সেখানে বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তাগন এসে ঢাকির দলের সাথে কথা বলে তাদের বাজনা বাজিয়ে দেখতেন।যে দলের বাজনা বাজিয়ে শোনার পর পছন্দ হত সেই দলের সাথে আলোচনা করে দাম স্থির করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুজো শেষ হবার পর খুব মর্যাদার সাথে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে সাথে জামা কাপড় দিয়ে দেয়া হয়।
কিন্তু আজকের দিনে ঢাকির চাহিদা কমতে শুরু করেছে। ঢাকির দল পুজো র সময়ে সারাদিন রাত পরিশ্রম করে তাদের চাহিদা মত উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে উপার্জন অর্থ পায় না।ফলে নবপ্রজন্ম ছেলেরা এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এখন আধুনিক প্রযুক্তি গত যন্ত্রাংশের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। আগামী দিনে ঢাক, কাঁসার চাহিদা যন্ত্রের মাধ্যমে মেটানো হবে।

আগে দুর্গাপুজাতে গানের আসর বসবে না।তা ভাবাই যেত না। পুজোর তিন দিন রাতে যাত্রা নাটক কবি গানের আসর বসানো হত।সাগরবাসা,নিমাই সন্ন্যাস, অরুণ বরুণ কিরণমালা, চাঁদ সওদাগর, বেহুলা লক্ষীনধরসহ নানান যাত্রা পালা।। আগরতলা পুর পরিষদ তাদের পুজো র কয়দিন কবি গানের আসর বসানো হয়। সেই আসরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের কবিয়াল এসে অংশ গ্ৰহন করতেন। এখন পুরো পরিষদের পূজা ও হয় না। কবিগানের আসর ও বসে না। নতুন প্রজন্ম এই সম্পর্কে কিছু জানে না। এখন আর পুজো র গানের এ্যলবাম বের হয় না।

এখন সারা বছর গান প্রকাশ হয়।সকল গান ওয়ান টাইম পর্যন্ত চলে। পরবর্তীতে এই গানের প্রচলন বেশি দিন থাকে না। পুরোনো দিনের গান তখন প্লে রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যেত । এখন তা অতিত হয়ে গেছে। পেনড্রাইভ বা সি ডি দিয়েও এখন গান সংগ্রহ করে রাখতে হয় না। এখন সব গান সকলের হাতে হাতে নিয়ে ঘুরছে। নতুন গানের ক্যাসেট বা রেকট প্লেয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় না।
এখন পূজা প্যান্ডলগুলোতো আধুনিক প্রযুক্তি গত যন্ত্রাংশের বাজনা চলে এসেছে। সেই কানফাটা ডি জে শব্দ দর্শনার্থীগন পছন্দ করেন বলে মনে হয় না। ডি জে শব্দ শব্দ দূষণের আওতায় আসলে পূজো বলে প্রশাসন পাশ কেটে চলেন বলে অভিযোগ।

একসময় পুজো কে কেন্দ্র করে নবাগত লেখক লেখিকা গন পূজা সংখ্যা সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়েছে। পূজার সংখ্যায় লেখকদের লেখা সংগ্রহ করতে লেখকদের বাড়িতে ছুটে যেত। বারংবার তাগাদা দিয়ে লেখা সংগ্ৰহ করে সেই লেখা ছাপা খানায় পোঁছে দেয়াহয়। ছাপাখানা থেকে ম্যাগাজিন তৈরি করে বের না হ ওয়া পর্যন্ত ছাড় নেই। সেই ম্যাগাজিনে লেখে নতুন লেখক হাত পাকিয়ে তুলেন।
রাজ্যে এক সময় প্রচুর ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারি ভাবে ম্যাগাজিনগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তা করা হয়েছিল। এখন আগের মত ম্যাগাজিন পূজা সংখ্যা বের হয় না। পূজা কমিটি গুলো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করার লক্ষ্যে ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন।সারা বছরের সাহিত্য চর্চা এখানে ই সমাপ্ত।রাজ্য সরকার তো সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন না। পূজা সং খায় বিজ্ঞাপন ও সরবরাহ করা হয় না।ফলে অনেক নতুন লেখক কবি আর্থিক সংকটের কারণে ম্যাগাজিন প্রকাশ থেকে সরে যাচ্ছে।

পূজার সময় ধনি গরিব সকলের নতুন জামা কাপড় লাগবেই। সেই সময় সকলে হাট বাজার থেকে নিজে দেখে জামা কাপড় কিনবে। নতুন জামাকাপড় গন্ধ ই আলাদা। সেই গন্ধ অন্য কাপড়ের মধ্যে নেই বলে মনে হয়। এখন কার মত সর্বত্র হাট বাজার ছিল না।চার পাঁচ বার আরো বেশি পথ মাটির রাস্তা পায়ে বাজারে যেতে হতো। দীর্ঘ পথ পায়ে শিশু, ছেলে মেয়ে দের সাথে নিয়ে মা বাবা বাজারে আসতেন। নতুন জামা কেনার আনন্দে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আসা যাওয়া করতে কোনো সমস্যা হত না।
এখন সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে বসে নেটের মাধ্যমে জামা কাপড়, জুতা সব কিছু অডার করে দেয়ার সাথে সাথে বাড়িতে সামগ্ৰী পৌঁছে যায়। কিন্তু এই জামা কাপড়ে নেই নতুনের স্বাদ।দোকানে গিয়ে দশ দোকান যাচাই করে দশ রকমের কাপড় দেখে কিনার আনন্দ আলাদা।

গত দুই বছর করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। সেই থেকে মানুষের পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে। সেই পুরনো পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। হারিয়ে যাওয়া কৃষ্টি সংস্কৃতি আগামী দিনে বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক র‌য়েছে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।