হাবেলী প্রতিবেদন।২অক্টোবর। আগরতলা।
শারদীয় উৎসব বাঙালি সর্ববৃহৎ উৎসব। এই উৎসব জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। একমাত্র উৎসব যে উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানে ধর্ম বিন্ন হয় থাকে আনন্দ থাকে সকলের। নাই কোন ভেদাভেদ। ছোট বড় ধনি গরিব সব মানুষের আনন্দ সমান থাকে। বাঙালি এই উৎসবের মত আর কোন উৎসব দীর্ঘদিন পর্যন্ত থাকে।
এই উৎসব ঘিরে থাকে এক উন্মাদনা। শারদীয় উৎসব ঘিরে সর্বত্র চলতে থাকে নাচ গান, হৈ হুল্লোড়, ।নানান বয়সের মহিলা কিশোর কিশোরী বয়স্ক ছেলে পুরুষ সকলেই পুজোতে চায় নতুন সাজে সাজতে।আর দুর্গোৎসব থেকে সমাজের অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে শুভ শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে।
দেবী দুর্গা হলেন শুভশক্তি তথা অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে দেবীর আরাধনা করা হয়। এই শক্তি হল বিশ্বের প্রাচীনতম মহেজ্ঞোদারো ও সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তিকদের মতে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের।খ্যাতনামা ইং রেজ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তিকবিদ জন মার্শালের মতে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগর কেন্দ্রিক। সেই সময় নগরবাসীগন অধ্যাত্ম পরায়ন , পূজা অর্চনা ও হর গৌরি বন্দনা প্রমান পাওয়া গেছে।সিন্ধুবাসীগন অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে শুভ শক্তির আরাধনা করতেন।
মার্কন্ডের পূরাণের মতে রাজা সুরথ শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে মেধস্ মুনির নির্দেশে বসন্তকালে দেবী দুর্গা পূজা করেছিলেন।যা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত।
কিন্তু ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নেবার পর তাকে উদ্ধার করতে রামচন্দ্র শরৎকালে অকাল বোধন করে দেবী দুর্গা পূজা করেন।
বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা হয় রাজশাহী জেলার তাহের পুর রাজা কংসনারায়ন রায়।
পরবর্তীতে বারোয়ারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
অপরদিকে আমাদের ত্রিপূরাতে প্রথম বারোয়ারী পূজা হয় ১৯৪৭ সালে আগরতলা পোস্ট অফিস চৌমুহনীতে।
মহারাজা ত্রিলোচন থেকে শুরু করে শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর পর্যন্ত পূজা চলে আসছে। দুর্গা বাড়িতে রাজ আমলের পুজো আজো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে আসছে।
রাজ্যে এই বছর মোট ২৫০৬ টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে।তার মধ্যে শহরে ৯৭৯ টি, গ্ৰামাঞ্চলে ১৫২৭টি , আগরতলা শহরে ৪৩৬ টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে।
সেখানে গত বছর রাজ্যে মোট ২১৭৬ টি পূজা করা হয়েছে। এবছর গতবারের চেয়ে ৩৩০টি বেশি পূজা করা হচ্ছে।
গত দুই বছর দেশে করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। করোনা প্রভাব থাকায় পুজোতে ভাটা পড়ে। এবছর করোনার প্রভাব নেই।ফলে পুজো র সংখ্যা বেড়েছে। রাজ্যের সর্বত্র জাতি উপজাতি, সং খ্যালঘু এবং সকল অংশের মানুষ একসাথে মিলে মিশে পুজোতে অংশ গ্ৰহন করেছে।
পূজার চাঁদা আদায় করা নিয়ে উদয়পুর শহরসহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রনে পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার মানিক সাহা পূজার সময়ে চাঁদাবাজি নিয়ে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ই দিকে নজর রাখতে আরক্ষা প্রশাসন কে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।
পূজার আগ মুহূর্তে আগরতলা শহরে চুরি ছিনতাই ঘটনা বেড়ে যায়।চরম আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠা মধ্যে শহরবাসী দিন কাটতে থাকে।
পূজার সময়ে শহরবাসী শান্তিতে নির্ভিগ্নে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। সেই দিকে নজর রেখে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরক্ষা প্রশাসন থানা থেকে আরম্ভ সকলকে বদলী করে দেন।আরক্ষা প্রশাসন কে ডেলে সাজানোর পর থেকে চুরি ছিনতাই ঘটনা অনেক কমেছে বলে জনগনের অভিমত।
পুজো যে লক্ষ নিয়ে শুরু হয়েছিল এখন সেই ভাবধারার থেকে পরিবর্তন দিকে যাচ্ছে।রাজসিক ও তামসিক ভাবধারায় সমাজের বিশাল অংশের জনগন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।এটা নিয়ে সকলের মধ্যে এখন পূজার ধূমধামের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এবারের পূজোতে বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয় যে গরিব দুস্থদের মধ্যে বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন এবং স্থানীয় বিধায়কগন শাড়ি বিতরণ করা হয়েছে। পূজার কয়দিন মানুষ আনন্দে মেতে থাকতে পারে সেই দিকে নজর দিয়ে রাজ্য সরকার সামাজিক ভাতা বৃদ্ধি করেছে। সাথে অনিয়মিত এবং নিয়মিত কর্মচারীদের পূজা অনুদান বৃদ্ধি করেছে।
অন্যদিকে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে বাজারে গিয়ে।
এদিকে পুজো র সময়ে অকাল বর্ষণে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পূজার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।উদ্যোত্তাগন পড়েছেন সমস্যায়। গতকাল কাঞ্চনপুর এবং আমবাসা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মসুলধারে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির কারণে দর্শনার্থীগন বাড়ি থেকে বের হতে পারে নি। আগরতলা শহরে এই বছর প্রথম পূজোর দুই দিন আগে থেকেই দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে। পুজো ঊদ্যোক্তা এবং প্রশাসনের আশঙ্কা এই বছর দর্শনার্থীদের ভিড় হবে। রাজের বিভিন্ন স্থানের দর্শনার্থী গন আগরতলা শহরের পুজো তে অং শগ্ৰহন করতে পারেন। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে বিশেষ ট্রেন চালু করেছে। সাথে আগরতলা শহরের আশপাশের দর্শনার্থী গন ঠাকুর দেখতে পারেন। সেই দিকে নজর রেখে টি আর টি সি কতৃপক্ষ বিশেষ বাস চালানোর কথা ঘোষণা করেছে।
এই বার আগরতলা শহরের ঊজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের সামনে দশমীর দিনে দুর্গা ঠাকুর জমায়েত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখান থেকে দুর্গা প্রতিমা সারিবদ্ধভাবে লাইন দিয়ে কামানচৌমহনী হয়ে হরিগঙ্গা বসাক রোড ধরে বটতলীতে গিয়ে দশমী ঘাটে চলে যাবে। সেখানে আগরতলা পুর পরিষদ নিজেদের উদ্যোগে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। একটা সময় উজ্জ্বয়ত প্রাসাদের সামনে দুর্গা প্রতিমা জমায়েত হয়। সেখান থেকে প্রথমে দুর্গা বাড়ি ,প্রভুবাড়ি এবং রাজ বাড়ির প্রতিমা প্রথমে লাইনে রাখা হয়। সরকারি আরক্ষা বাহিনীর জোয়ানগন দুর্গা বাড়ির প্রতিমা কে গার্ড অফ অনার দিয়ে সবার নিয়ে যাওয়া হয়।
এক সময়ে প্রতিমা ক্যানেভাল
দেখতে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের সামনে রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা ছোট বেলায় এই দৃশ্য দেখে ছি। তুলসীবতি স্কুলের ছাত্রী আবাসের সামনে একটি গেইট ছিল। সেই গেইটি ছিল অনেক উঁচুতে। গেইটের উপরে মানুষ বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে এসে রাজ্য পাল সহ অন্যান্য ভি ভি আই পিগন বসতেন।রাজ্যপাল এসে পৌঁছে যাবার পর একে একে প্রতিমা দশমী ঘাটে র দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।এই দৃশ্য উপভোগ করতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু দূর দূরান্তের দর্শনার্থী এসে ভিড় জমিয়ে অপেক্ষা করে দশমীর আনন্দ অনেক রাত উপভোগ করে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যেত। সেই আজকের মত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। ছিল না প্রযাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা। এখনকার মতো যানবাহনের ব্যবস্থা থাকত তাহলে সারা রাত ভর দর্শনার্থী জেগে বিজয়া দশমী উপভোগ করতে পারে। সেই স্মৃতি আজও ভুলার নয়।
আগরতলা শহরের উল্লেখযোগ্য ক্লাবগুলো হল রামঠাকুর সংঘ, ছাত্রবন্ধু ক্লাব, সেবক সংঘ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ক্লাব , এম বি বি ক্লাব, নেতাজী প্লে ক্লাব, সংহতি ক্লাব, লাল বাহাদুর ক্লাব , পোলষ্টার ক্লাব, ফ্লাওয়ারস ক্লাব, শতদল সংঘ, তুষার সংঘ, আজাদ হিন্দ ক্লাব, এম বি বি ক্লাব, যুব সংস্থা,লোর্টাস ক্লাব, মর্ডাণ ক্লাব,যুব সমাজ, ভারতরত্ন ক্লাব,ইত্যাদি।
বিশাল গড় মহকুমাতে তরুণ সংঘ, গ্ৰিন ত্র্যারো ক্লাব,বিশ্বপ্রিয় ক্লাব, যুবসংস্থা, তরুণ সংঘ, অফিস টিলা যুবক সং ঘ,
এখন পুজো র সময়ে যাত্রাগানের আসর বসে না। সেই সাথে হারিয়ে গেছে বিভিন্ন পালাগানের আসর। সেই সময় হারিয়ে যাওয়া বাংলা গান আজও প্যান্ডেলগুলোতে সমান তালে কদর রয়েছে। এখন কার ডি জে গানের আসর একবছর পর ই হারিয়ে যায়।
পুজো উপলক্ষে এখন আগের মত সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয় না। এখন অধিকাংশ ই আধুনিক ধারায় লিখতে অবস্ত।
আধুনিক কতার ছৌয়ায় এখন নেট দুনিয়ার ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন বাজার মন্দা।এরা এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে।